খবররাজশাহীলীড

নির্বাচনকে ঘিরে রক্তাক্ত সংঘাতে উত্তপ্ত রাজশাহী সিটি,পরিস্থিতি সামলাতে ১০ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ

আবুল কালাম আজাদ (রাজশাহী):- রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রচারে নেমেই সংঘাতে জড়িয়েছেন কাউন্সিলর প্রার্থীরা। শান্ত নগরীতে অশান্ত উত্তাপ।ফলে রক্তাক্ত সংঘাতে উত্তপ্ত রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন।
শুক্রবার থেকে প্রচার শুরু হওয়ার পর গত তিনদিনে বেশ কয়েকটি মারামারি ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এসব হাঙ্গামার বেশির ভাগই ঘটেছে প্রার্থীদের মধ্যকার পুরনো বিরোধকে কেন্দ্র করে। এ ছাড়া ফৌজদারি মামলার অনেক আসামি প্রার্থী হওয়ার কারণেও বাড়তি একটা উত্তেজনা রয়েছে।
এবার ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ১১২ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এদের মধ্যে ৩৮ জনের নামেই রয়েছে ফৌজদারি মামলা। ২০ মামলার আসামিও আছেন প্রার্থীর তালিকায়।
অন্যদিকে , নির্বাচন প্রচারকে কেন্দ্র করে চলমান সহিংস পরিস্থিতি সামলাতে ১০ জন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিয়েছে জেলা প্রশাসক।তারা আগামী ১৯ জুন পর্যন্ত মাঠে থাকবেন ।
 রাজশাহী জেলা প্রশাসক ও ম্যাজিস্ট্রেট শামীম আহমেদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে জটিল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বর্তমান কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন আনারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে। আনারের সমর্থকরা গত শুক্রবার বিকালে সাবেক কাউন্সিলর বিএনপি নেতা টুটুলের নির্বাচনী কার্যালয়ে ভাঙচুর চালায় বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া আনারের বিরুদ্ধে টুটুলের সমর্থকদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগও আছে। এসব ঘটনায় ওই ওয়ার্ডে উত্তেজনা বিরাজ করছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আনার বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা সঠিক নয়। আমরা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই।’
১৯ নম্বর ওয়ার্ডে সবচেয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসন কঠোর না হলে এ ওয়ার্ডে প্রাণহানিরও আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর তৌহিদুল হক সুমনের সঙ্গে কাউন্সিলর প্রার্থী আশরাফ বাবুর দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। গত শনিবার সন্ধ্যায় কাউন্সিলর সুমনের সহযোগীদের ছুরিকাঘাতে কাউন্সিলর প্রার্থী বাবুসহ তার তিন সমর্থক আহত হন। ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে কাউন্সিলর প্রার্থী আশরাফ বাবু ফেসবুক লাইভে এসে প্রতিদ্বন্দ্বী সুমনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান। কাউন্সিলর সুমন পর্নোগ্রাফি মামলার আসামি। এ কারণে সুমনকে মহানগর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ছুরিকাঘাতের ঘটনার পর এ ওয়ার্ডে বেশ উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। সুমন এবং বাবুর একে অপরের সমর্থকরা মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ায় বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সাত নম্বর ওয়ার্ডের পরিস্থিতি ক্রমেই জটিলের দিকে যাচ্ছে। এ ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর রাজশাহী মহানগর যুব মৈত্রীর সভাপতি মতিউর রহমান মতির সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী জহিরুল ইসলাম রুবেলের দ্বন্দ্ব রয়েছে। ২০১৮ সালের জুলাইয়ের নির্বাচনে ফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বড় সংঘর্ষ হয়। ওই ঘটনা নিয়ে বর্তমান কাউন্সিলর মতির বিরুদ্ধে একটি মামলাও আছে। এ ছাড়া রুবেলের নামে অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা রয়েছে। একটি হত্যা মামলা থেকে ২০১৮ সালে খালাস পান তিনি। কাউন্সিলর প্রার্থী মতির অভিযোগ, নির্বাচনে বিজয়ী হতে প্রতিপক্ষের লোকজন এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করছেন এবং কালো টাকা ছড়াচ্ছেন। রাতে সমর্থকরা বাসায় থাকতে পারছেন না। তিনি নিজেও বাইরে থাকছেন; সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জিডি করার। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রুবেল।
নগরীর আট নম্বর ওয়ার্ডে ত্রিমুখী সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমান কাউন্সিলর এসএম মাহবুবুল হক পাভেল, জানে আলম খান জনি এবং শাহিদ হাসান বারিকের সমর্থকরা মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এরা তিনজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উত্তেজনা আছে।
১১ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি নেতা সাবেক কাউন্সিলর আবু বাক্কার কিনু এবং বর্তমান কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা রবিউল ইসলাম তজুর মধ্যেও দ্বন্দ্ব প্রকট। এক সময় তজুও বিএনপি করতেন। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে কাউন্সিলর হয়েই আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ফলে কিনু ও তজুর সমর্থকরা প্রায়ই মুখোমুখি অবস্থানে চলে যান।
১৩ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আব্দুল মোমিন এবং মহানগর যুবলীগের শিল্পবিষয়ক সম্পাদক মাসুদ রানার সমর্থকের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
২২ নম্বর ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বর্তমান কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হামিদ সরকার টেকন এবং বিএনপি নেতা মির্জা পারভেজ রিপন। টেকনের পক্ষে মাঠে নেমেছেন তার ভাই মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার, ভাগ্নে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইশতিয়াক আহমেদ লিমন, ছোট ভাই মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জেডু সরকার এবং ২২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেডু সরকার। অন্যদিকে বিএনপি নেতা রিপনের পক্ষে মাঠে রয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক মীর তৌফিক আলী ভাদু, তার ছেলে মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর তৌহিদুর রহমান কিটু, মহানগর যুবলীগের বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান খান মনির, মহানগর ছাত্রলীগের সহসভাপতি ফজলে রাব্বি। এ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের দুটি পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ায় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। ২৩ নম্বর ওয়ার্ডেও রয়েছে উত্তেজনা। এ ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মাহাতাব হোসেন চৌধুরী। তিনি রাজশাহী মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। এলাকায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান রনির সঙ্গে তার চরম বিরোধ। রনি বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য আইনে মামলা চলছে।
নগরীর ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি নেতা তরিকুল আলম পল্টু এবং সাবেক ছাত্রদল নেতা আলিফ আল মাহামুদ লুকেনের মধ্যে চরম বিরোধ রয়েছে। কাউন্সিলর পল্টু চাঞ্চল্যকর পুলিশ কনস্টেবল সিদ্ধার্থ হত্যা মামলার আসামি। এ ছাড়া ২৬, ২৮, ২৯ এবং ৩০ নম্বর ওয়ার্ডেও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর শহিদুল ইসলাম পিন্টুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আলাউদ্দিনের সমর্থকদের উত্তেজনা বিরাজ করছে। তারা দুজনেই আওয়ামী লীগ নেতা। জয়ী হতে দুজনই মরিয়া।
নির্বাচনী পরিবেশ সম্পর্কে সুশাসন বিশ্লেষক সুব্রত কুমার পাল বলেন, ‘ভোটে সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। কিন্তু অনেক প্রার্থীই আচরণবিধি মানছেন না; সবাই তা দেখছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। নির্বাচন কমিশন সাহস না দেখালে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হতে পারে।’
এ বিষয়ে রাসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনার খবর শুনেছি। কিন্তু কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি। লিখিত অভিযোগ পেলে কমিশন ব্যবস্থা নেবে।’
পরিস্থিতি সামলাতে মাঠে থাকছেন ১০ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ:-
 আসন্ন ২১ জুন রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচনের
নির্বাচন প্রচারকে কেন্দ্র করে চলমান সহিংস পরিস্থিতি সামলাতে ১০ জন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দিয়েছে জেলা প্রশাসক।তারা আগামী ১৯ জুন পর্যন্ত মাঠে থাকবেন ।
 রাজশাহী জেলা প্রশাসক ও ম্যাজিস্ট্রেট শামীম আহমেদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
এর মধ্যে নগরীর ২২, ২৩ ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে আছেন রাজশাহী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ক্যান্টনমেন্ট এক্সিকিউটিভ অফিসার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ আলী, ২৬, ২৭ ও ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে আছেন বোয়ালিয়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট শাহীন মিয়া, ৩, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্ব রয়েছেন পুঠিয়া সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট আরাফাত আমান আজিজ, ১৬, ১৭ ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে পবা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট অভিজিত সরকার, ২৫, ২৮ ও ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে রয়েছেন গোদাগাড়ী সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. সবুজ হাসান, ১৩, ১৪ ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে আছেন রাজশাহী জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নাফিস এলাহী, ৭, ৮ ও ১০ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে আছেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. শামসুল ইসলাম, ১৯, ২০ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া আক্তার লুবনা, ১, ২ ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট সাকিব হাছান খান ও ৯, ১১ ও ১২ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে আছেন সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট সানিয়া বিনতে আফজল।
রাজশাহী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শামীম আহমেদ জানান, নির্বাচনি আচরণবিধি অনুসরণের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রয়োজনীয় আইনগত নির্দেশনা প্রদান এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ অর্পিত নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করবেন তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *